তামিমকে নতুন করে চিনল ইংল্যান্ড
ইংল্যান্ড ১ম ইনিংস:
বাংলাদেশ ১ম ইনিংস: ২২১/৫
দুঃখটা কার বেশি-তামিম ইকবালের, না মুমিনুল হকের?
প্রশ্নটাই কেমন যেন! তামিম করেছেন ৭৮ রান, মুমিনুল ০। তার পরও কি চাইলে ‘দুঃখ-সেতু’র এপার-ওপারে দুজনকে বসিয়ে দেওয়া যায় না!
বাংলাদেশের একজন ব্যাটসম্যানকে যদি ইংল্যান্ড ভয় পায়, প্রশ্নাতীতভাবে তিনি তামিম। একটা টীকা অবশ্য লাগছে-সাদা পোশাকের তামিম। ওয়ানডেতেও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেঞ্চুরি আছে। তবে বাকি ১১ ইনিংসে ৫০ পেরোতে পারেননি একবারও। টেস্টে ৯ ইনিংসে যেখানে মাত্র দুবারই পঞ্চাশ ছোঁয়া হয়নি। চট্টগ্রাম টেস্টের প্রথম ইনিংসের পর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তামিমের টেস্ট গড় ৬৪.৭৭। তবে এর আগে ৮৬ ও ৮৫ রানের দুটি ইনিংসের মতো এখানেও সেঞ্চুরির সুবাস পেতে পেতে তা হারিয়ে ফেলার দুঃখ তো থাকছেই।
তা দুঃখগাথায় মুমিনুল কীভাবে সঙ্গী হয়ে যাচ্ছেন তাঁর? মুমিনুলের দুঃখ অন্য। টেস্ট ক্রিকেটে প্রায় পনেরো মাসের বিরতি বাংলাদেশ দলের সবার জন্যই সমান। কিন্তু বাকিদের জন্য মাঝখানে ওয়ানডে ছিল, ছিল টি-টোয়েন্টি। রঙিন পোশাকে ব্রাত্য মুমিনুলের তো শুধু টেস্ট ক্রিকেটটাই সম্বল। আবার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের স্বাদ পেতে তাই দীর্ঘ প্রতীক্ষায় কেটেছে তাঁর দিন। আর ৪৪৮ দিন পর ব্যাটিং করার সুযোগ পেয়ে কিনা ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় শূন্য! মুমিনুলের চেয়ে দুঃখী আর কে আছে!
অপেক্ষার কথা যদি বলেন, তাহলে অবশ্য গ্যারেথ ব্যাটি হারিয়ে দিচ্ছেন বাকি সবাইকে। সেটিও বিপুল ব্যবধানে। চট্টগ্রামের আগে সর্বশেষ টেস্ট খেলেছেন সোয়া ১১ বছর আগে। সেটিও বাংলাদেশের বিপক্ষেই। ডারহাম টেস্টে প্রথম ইনিংসে বোলিংই করেননি। দ্বিতীয় ইনিংসে একটিই উইকেট। ২০০৫ সালের ৪ জুন মোহাম্মদ আশরাফুলের উইকেট নিয়েছিলেন। টেস্ট উইকেট পেলে কেমন লাগে, এত দিনে তা ভুলে যাওয়ারই কথা। ইংলিশ অফ স্পিনার ভুলে যেতে বসা সেই স্বাদ পেলেন বাংলাদেশের ইনিংসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উইকেটটি নিয়ে। টেস্টে তামিমের ডাবল সেঞ্চুরি আছে। তার পরও এখানে সেঞ্চুরি পেলে নির্দ্বিধায় এটিকে ক্যারিয়ারের সেরা ইনিংস বলে রায় দিয়ে দিতেন। তা না পাওয়ার পরও ‘সেরা ইনিংসের একটি’ হয়ে থাকছে এই ৭৮। কারণটা অবশ্যই উইকেট। যে উইকেটে ‘সেট ব্যাটসম্যান’ বলে কিছু নেই। কয়েক ঘণ্টা ব্যাটিং করার পরও এমন একটা বল আসতে পারে, যেটিতে ব্যাটসম্যানের কিছুই করার থাকে না। যেমন করার থাকল না তামিমেরও।
আউট হওয়ার আগ পর্যন্ত নিজের অন্য রূপ দেখিয়েছেন তামিম। এর আগে স্ট্রোক প্লেতে ঝলমল তামিমকেই দেখেছে ইংল্যান্ড। এদিন দেখল দৃঢ়প্রতিজ্ঞায় শাণিত তামিমের নিবেদন। ৪৮তম বলে প্রথম বাউন্ডারি। ফিফটি ১৩১ বলে। শেষ পর্যন্ত ১৭৯ বলে ৭৮। স্ট্রাইক রেট মাত্র ৪৩.৫৭। ‘মাত্র’ই, ২০১০ সালে লর্ডস ও ওল্ড ট্রাফোর্ডে বলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দুটি সেঞ্চুরির কথা বাদই দিন। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তামিমের আগের ৪টি হাফ সেঞ্চুরির মধ্যে সবচেয়ে ‘শান্তশিষ্ট’টির স্ট্রাইক রেটও তো ৬১.৯০।
ব্যাটির ওই একটিই উইকেট, মঈন আলী নিয়েছেন ২টি, অন্য দুটি স্টোকস ও রশিদের। তবে এদিন ইংল্যান্ডের সেরা বোলার এঁদের কেউই নন। সেরা বোলারের নাম-‘বিরতি!’ লাঞ্চের ঠিক আগের ওভারে মঈন আলীর চার বলের মধ্যে আউট হয়েছেন ইমরুল ও মুমিনুল। তামিমের সঙ্গে ৯০ রানের জুটি গড়ে সেই ধাক্কা সামলানো মাহমুদউল্লাহ গেলেন চা-বিরতির আগের ওভারে। পড়ন্ত বিকেলে ম্যাচে সমতা নিয়ে আসা মুশফিকুরের উইকেটটিও দিনের খেলা শেষ হওয়ার মাত্র ২.৩ ওভার বাকি থাকতে।
শুরু থেকেই এমন দারুণ খেলছিলেন যে, মনে হচ্ছিল বাংলাদেশ-অধিনায়ক বুঝি ভিন্ন উইকেটে ব্যাটিং করছেন! মুশফিক থাকলে রোমাঞ্চকর দুটি দিন শেষে বাংলাদেশকেই এগিয়ে রাখা যেত। এখন দুই দল একই সমতলে। হাতে ৫ উইকেট নিয়ে ৭২ রানে পিছিয়ে বাংলাদেশ। আজ তৃতীয় দিনটি অনেকটাই ঠিক করে দেবে এই টেস্টের ভাগ্য। যা ঠিক করে দেওয়ায় বড় ভূমিকা রাখার সুযোগ ৩১ রানে অপরাজিত সাকিবের। প্রত্যাশা-চাপ এসবকে গায়ে না মাখার আশ্চর্য এক ক্ষমতা আছে তাঁর। এখানেও সেটির ব্যতিক্রম হচ্ছে না। দ্বিতীয় দিনের খেলা শেষে র্যাডিসন ব্লু হোটেলে ফেরার পর সুইমিংপুলে তাই দেখা মিলল হাসিখুশি নির্ভার সাকিবেরই। পরদিনের প্রথম সেশনটিই যে এই টেস্টের চাবিকাঠি হাতে নিয়ে বসে আছে-নিজেই বললেন সেটি। চাবিকাঠি আসলে তাঁর হাতেই শুনে হাসিতেই দিয়ে দিলেন উত্তর।
সুইমিংপুলেই বাংলাদেশের আরেক খেলোয়াড়ের মুখে হাসিটা যেন স্কচ টেপ দিয়ে আটকানো। সৌম্য সরকার আর নুরুল হাসানের সঙ্গে সাঁতরাতে সাঁতরাতেই মেহেদী হাসান মিরাজ জানলেন, বাংলাদেশের পক্ষে অভিষেক টেস্টে তাঁর আগে ইনিংসে ৬ উইকেট নিয়েছেন আরও চারজন। তবে ম্যাচে ১০ উইকেট কারোরই নেই। শোনার পর তাঁর প্রশ্ন-বিশ্বে কার আছে? বব ম্যাসি ও নরেন্দ্র হিরওয়ানির অভিষেক টেস্টেই ১৬ উইকেট আছে শোনার পর বিস্ময়, ‘বলেন কী! দুই ইনিংসেই ৮ উইকেট!’ ওই দুজনই পরে হারিয়ে গেছেন শুনে একটা ডুব দিয়ে উঠে বললেন, ‘তাহলে আমার ১৬ উইকেট নেওয়ার দরকার নেই। আমি হারিয়ে যেতে চাই না।’
ম্যাসি-হিরওয়ানির কীর্তি ছুঁতে দ্বিতীয় ইনিংসে লেকার বা কুম্বলে হয়ে যেতে হবে মিরাজকে। নিতে হবে ইনিংসের ১০টি উইকেটই। সেই ‘অসম্ভব’কে ধাওয়া করার চেয়ে আর ৪টি উইকেটই না হয় আরাধ্য হোক তাঁর।
মিরাজ তা পারবেন কি না কে জানে, তবে ইংল্যান্ডকে বাংলাদেশের বিপক্ষে সবচেয়ে কম রানে অলআউট করে দেওয়ায় তাঁরই সবচেয়ে বড় ভূমিকা। ২০০৩ সালে ঢাকায় দুই দলের প্রথম টেস্টে ২৯৫ রানে শেষ হয়েছিল ইংল্যান্ডের প্রথম ইনিংস। এখানে শেষ হলো ২ রান কমে।
প্রথম দুই দিনে দারুণ একটি টেস্ট ম্যাচের পূর্বাভাস শেষ পর্যন্ত কতটা সত্যি হবে, দুই দলই সেটি জানতে ব্যগ্র প্রতীক্ষায়। আরেকজনও বোধ হয় এই টেস্ট নিয়ে কম দুশ্চিন্তায় নেই। প্রথম দিন তিন-তিনবার ডিআরএস ভুল প্রমাণ করেছে তাঁর সিদ্ধান্ত। কাল সকালে ইংল্যান্ড ইনিংসে আরও একবার নিজের সিদ্ধান্ত গিলতে হলো। বাংলাদেশ ইনিংসে তামিমকে ভুল আউট দেওয়ার পর আরও একবার। ডিআরএসের পুরো ফর্মটাকে ‘ডিসিশন রিভিউ সিস্টেম’-এর বদলে ‘ধর্মসেনা রিভিউ সিস্টেম’ ডাকা উচিত বলে রসিকতাও চালু হয়ে গেছে।
এই টেস্টটা শেষ হলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন কুমার ধর্মসেনা!
No comments:
Post a Comment