Friday, October 21, 2016

সেলফির ভালো-মন্দ

বিমান উড়বে, এমন সময় ভারতের এমটিভির গ্রেট সেলফি চ্যালেঞ্জ প্রতিযোগিতার বিজয়ী ক্লিন্স ভার্গেস মুঠোফোনের ক্যামেরায় পটাপট কয়েকটা সেলফি তুলে ফেললেন। কয়েকজন যাত্রীর মুখে মৃদু হাসি, কেউবা হতবুদ্ধির, কেউবা ঢুলছেন। ৫৫টির বেশি সেলফি তোলা হলো। একবার বাধা এল। কিন্তু পাত্তা দিলেন না ভার্গেস। বললেন, ‘এ ব্যাপারে আমি একটু বেশরম।’


ঘটনা সেখানেই থেমে থাকেনি। বেসামরিক বিমান কর্তৃপক্ষের মহাপরিচালক সম্প্রতি বিমানের যাত্রী ও ক্রুদের ওপর সেলফি তোলায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন।
কেন এই নিষেধাজ্ঞা! যেখানে ভারতে সেলফি নিয়ে সিনেমা থেকে শুরু করে অনেক কর্মকাণ্ডই শুরু হয়েছে। তেলেগু ছবি সেলফি রাজা, মালয়লাম ছবি আ নর্দান সেলফি (ওরু ভারাকান সেলফি) বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। এ ছাড়া জনসচেতনতামূলক কাজেও সেলফির ব্যবহার চলে এসেছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ‘বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও’ কর্মসূচিতে অনেকেই সেলফি তুলে হ্যাশট্যাগ দিয়ে সেলফিউইথডটার লিখে শামিল হয়েছেন।
তাহলে সেলফি তোলা কী রোগ, যার জন্য এই নিষেধাজ্ঞা! সেলফি বিশ্বের মানুষের কাছে যতই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে, ততই বিতর্ক উঠছে যে সেলফি আসলেই ফ্যাশন না ব্যাধি? উঠছে পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি।
ভারতের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড নিউরোসায়েন্সেসের (এনআইএমএইচএএনএস) ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক পৌলমি এম. সুধীর বলেন, সেলফি তোলা এখন একটি ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। প্রযুক্তির ক্রমাগত উন্নতি ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের কারণে এর এত বিস্তৃতি হয়েছে।
সম্প্রতি ইন্ডিয়া টুডের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, ২০০৩ সালের দিকে মানুষ সামনের ক্যামেরাসহ মুঠোফোন হাতে পাওয়া শুরু করে। ২০১০ সালের শুরুর দিকে ইনস্টাগ্রাম ও স্নাপচ্যাটে সেলফি জনপ্রিয় হওয়া শুরু করে।
লোকমান্য তিলক মিউনিসিপাল মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতালের মনোচিকিৎসক অবিনাশ ডিসুজা বলেন, সেলফি হলো আলোকচিত্রের চলমান কসমেটিক সার্জারি।
বর্তমানে যে কেউ নিজের সেলফি তুলে তা সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটে শেয়ার করেন। সেখানে অনেক অপরিচিত থাকেন। তাঁরাও ছবিগুলো দেখেন। এসব অপরিচিত লোক নিজের প্রতি ভালোবাসাকে যেমন সমর্থন করেন, তেমনি গোপনীয়তা বলতেও কিছু থাকে না।
অবিনাশ ডিসুজা বলেন, ওই মুহূর্তে আপনাকে কেমন দেখাচ্ছে, তা সেলফি তুলে দেখা যেতে পারে। আপনাকে যদি কালো দেখায়, তাহলে সেলফিতে নিজেকে একটু ফরসা করে নিতে পারেন। যদি স্থূলকায় মনে হয়, তবে গড়ন কিছুটা হালকা করে নিতে পারেন। সেলফি নিজের প্রতি নিজের একটি ধারণা দাঁড় করিয়ে দেয়।
তবে অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো নয়। এই সেলফি তরুণদের প্রতি নেতিবাচক প্রভাবও ফেলতে পারে। বেঙ্গালুরুর ১৮ বছর বয়সী এক তরুণী দিনের বেশির ভাগ সময় সেলফি তুলে তা সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটে শেয়ার করতেন। ওই তরুণী বিষণ্নতায় ভুগতেন। পরে দেখা গেল, মেয়েটির বিষণ্নতার পাশাপাশি ‘বডি ডিসমরফিক ডিসঅর্ডার (বিডিডি)’ সমস্যা রয়েছে।
এ ব্যাপারে প্রযুক্তিগত আসক্তি-বিষয়ক গবেষক ও এনআইএমএইচএএনএস-এর চিকিৎসক মনোজ কুমার বলেন, ওই মেয়েটির প্রতি দুটি সেলফি তোলার মধ্যে সময়ের ব্যবধান ছিল ২০ মিনিট। যদি শেয়ার করা সেলফির নিচে মন্তব্যগুলো ভালো না হয়, তাহলে তিনি আরও ভালো সেলফি তোলার ও নিজেকে আকর্ষণীয় করে তোলার পেছনে অনেক সময় ব্যয় করতেন।
তবে আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশন (এপিএ) সেলফিকে রোগ হিসেবে বিবেচনা করছে না। তারা বলছে, এতে নিজের প্রতি একধরনের সচেতনতা আছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রে এখন নগ্ন সেলফিও তোলা হচ্ছে। ইনস্টাগ্রামে কিম কার্দাশিয়ানের এমন একটি সেলফি বেশ বিতর্কের ঝড় তুলেছিল।
মুম্বাইয়ের লোকমান্য তিলক মিউনিসিপাল মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতালের মনোচিকিৎসা বিভাগ থেকে সেলফি নিয়ে একটি গবেষণা হয়েছে। ইন্ডিয়ান জার্নাল অব সাইকোলজিক্যাল মেডিসিন নামের একটি পত্রিকায় প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দ্বাদশ শ্রেণিপড়ুয়া ২৫২ জন শিক্ষার্থীর ওপর এই গবেষণা চালানো হয়। এর মধ্যে ২৭ দশমিক ৪ শতাংশ শিক্ষার্থী সপ্তাহে কমপক্ষে ১০টি সেলফি তোলেন। ৬৯ দশমিক ১ শতাংশ শিক্ষার্থী যখন নতুন পোশাক পরেন বা কোনো অনুষ্ঠান উপলক্ষে কেবল সেলফি তোলেন।
অধ্যাপক পৌলমি এম সুধীর বলেন, মেয়েদের মধ্যে একটা প্রবণতা কাজ করে যে যতটা না ছবি তার চেয়ে শরীরের গড়ন ঠিকঠাক তোলা চাই। এটা একধরনের ওবেসিভ কমপালসিভ ডিস-অর্ডার। সেলফির মাধ্যমে তাঁরা আসলে তারকাখ্যাতি পেতে চান।
তবে এই সেলফির ফলাফল কোনো কোনো সময় বেদনাদায়কও হতে পারে। সেলফি তুলতে গিয়ে ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে, পাহাড় থেকে পড়ে, নদীতে ডুবে নিহত হওয়ার খবর অনেকেরই জানা। এমনকি মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন একজন। দেশটির পর্যটন মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, সেলফি তুলে প্রাণহানির দিক দিয়ে ভারত তালিকার শীর্ষে রয়েছে। ২০১৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ভারতে সেলফি তোলা-সংক্রান্ত দুর্ঘটনায় অন্তত ৫৪ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। ২০১৫ সালেই ১৫ জন নিহত হয়েছেন। এ কারণে মন্ত্রণালয় থেকে দেশের বিপজ্জনক এলাকা চিহ্নিত করে মোট ১৬টি স্থান ‘নো সেলফি জোন’ ঘোষণা করা হয়েছে। সেখানে সেলফি না তোলার জন্য সতর্কবার্তাও টাঙানো হয়েছে।
সেলফি টিপস
সেলফি ব্যাধি নাকি ফ্যাশন—এই বিতর্ক যেহেতু থেমে নেই, তাই থেমে থাকবে না সেলফি তোলাও। সম্প্রতি দিল্লির দ্য ইন্ডিয়া হ্যাবিটেট সেন্টার ‘ফ্রম সেলফ পোট্রেট টু সেলফি’ শীর্ষক একটি কর্মশালার আয়োজন করেছিল। সেখানে আলোকচিত্রী পার্থিব শাহ সুন্দর সেলফি তোলার বেশ কিছু কৌশল বাতলে দিয়েছেন। যেমন কী করে নাক আরও আকর্ষণীয় করে তুলবেন, কী করে ছবির বিকৃতি এড়ানো যায় ইত্যাদি। তিনি বলেন, সেলফি তোলার সময় মোবাইল ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকানো ঠিক নয়। স্ক্রিনের সঙ্গে আপনার মুখের দূরত্ব থাকবে ঠিক দুই ডিগ্রি কোণে। এতে সেলফি অনেক আকর্ষণীয় করে তোলা যাবে।
আলোকচিত্রী পার্থিব শাহ বলেন, আজকের দিনে কেউ প্রসাধনকক্ষে থাকলে, ক্যাফেতে বা ক্যাটরিনা কাইফের সঙ্গে থাকলে সেলফি তুলে ফেলেন। এটা ঠিক নয়। এ ব্যাপারে আরও সতর্ক থাকতে হবে।

No comments:

Post a Comment

Pages

 

Sample text

Sample Text

 
Blogger Templates