Monday, November 14, 2016

দ্বিজেনের চোখ গেলে আঁধার নামবে পরিবারেও


হাসপাতালের বিছানায় অনেকটা অসাড় হয়ে শুয়ে আছেন দ্বিজেন টুডু (৩৮)। বিছানার এক পাশে তাঁর বোন মার্থা টুডু। আহত দ্বিজেনের কথা বলার শক্তিও নেই। অস্ফুট স্বরে মাঝেমধ্যে শুধু বলছেন, ‘ব্যথা, ব্যথা’।

গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের সাহেবগঞ্জে রংপুর চিনিকলের জমি উদ্ধারের সময় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে আহত হন সাঁওতাল সম্প্রদায়ের দ্বিজেন। ওই সংঘর্ষের সময় ছোড়া ছররা গুলি তাঁর বাঁ চোখে ঢুকে গেছে। লেগেছে ডান চোখের পাশেও।

দ্বিজেন এখন আছেন রাজধানীর জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে। তাঁর চিকিৎসার জন্য গঠিত মেডিকেল বোর্ডের সদস্য সহযোগী অধ্যাপক সাইফুদ্দিন পিন্টু বলেন, ‘দ্বিজেনের ডান চোখের পাশে ছররা গুলি লেগেছে। তবে ভয়ানকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাঁ চোখটি। এর ভেতরে গুলি ঢুকে গেছে। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি এটি যাতে নষ্ট না হয়ে যায়। তবে কোনো কিছুই এখন বলা যাচ্ছে না।’ একজন চিকিৎসকের মতে, দ্বিজেনের বাঁ চোখ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। এ চোখে দৃষ্টিশক্তি হারানোর শঙ্কা বাদ দেওয়া যায় না।


তিন সন্তানের বাবা দ্বিজেন পেশায় দিনমজুর। স্ত্রী, তিন সন্তান আর বৃদ্ধ মা-বাবাকে নিয়ে তাঁর পরিবার। দ্বিজেনের বড় ছেলে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। মেজটি পড়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে। ছোট ছেলেটির বয়স আড়াই বছর। এত দিন কেবল পরিবারের সদস্যদের মুখে দুমুঠো অন্ন তুলে দেওয়ার লড়াই করতে হয়েছে দ্বিজেনকে। আর এখন এর সঙ্গে লড়তে হচ্ছে চোখ দুটি রক্ষা আর নিজের কর্মক্ষমতা ফেরানোর। হতদরিদ্র দ্বিজেন ভালো করেই জানে, চোখ না বাঁচলে তাঁর জীবনের যেমন কোনো নিশ্চয়তা নেই, তেমনি পুরো পরিবারকে পড়তে হবে চরম অনিশ্চয়তায়।
সাত সদস্যের পরিবারে দ্বিজেন একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। সন্তানদের দেখভাল করার জন্য এক বোন ছাড়া পরিবারের কেউ সঙ্গে আসতে পারেনি। মার্থা জানান, এ যাবৎ​ চিকিৎসায় জমানো অর্থ প্রায় পুরোটাই শেষ হয়ে গেছে। হাসপাতালে কেউ কেউ এসে কিছু সহযোগিতা করেছেন। তা দিয়েই চলছে এখন।
এভাবে চিকিৎসা হয়তো চলবে, বন্দিদশাও কাটবে উত্তর জনপদের এই সাঁওতাল যুবকের। তবে চোখ হারানোর আশঙ্কায় থাকা এই সাঁওতাল পরিবারের আরেক আশঙ্কা সামনের দিনগুলো নিয়ে। দ্বিজেনের শরীরটি যদি তার কর্মক্ষমতা হারায়, তখন কী হবে? মার্থা বলছিলেন, ‘এক মুঠ চাল নিয়ে আসবে, পরিবারে এমন কেউ নেই তো। ভাইয়ের চোখ গেলে সবাই অন্ধকারে পড়ে যাবে।’ 
আহত ও দৃষ্টিশক্তি রক্ষার লড়াইয়ে থাকা এই সাঁওতাল যুবকটি কিন্তু বন্দী। দ্বিজেনের শয্যার উল্টো দিকের শয্যায় সাধারণ পোশাকে বসে আছেন পুলিশের তিন সদস্য। সবাই গাইবান্ধা জেলা পুলিশের সদস্য। দ্বিজেনকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে গ্রেপ্তার করা হয় ওই সংঘর্ষের ঘটনার মামলায়। এরপর থেকে তিন পুলিশ দ্বিজেনের সঙ্গেই আছে।
দুটি চোখ শুধু নয়, দ্বিজেনের শরীরের নানা অংশে রয়েছে গুলি।
৬ নভেম্বর গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সাহেবগঞ্জ এলাকার সাঁওতাল-অধ্যুষিত মাদারপুর ও জয়পুর গ্রামে পুলিশ ও চিনিকলের শ্রমিক-কর্মচারীদের সঙ্গে সাঁওতালদের সংঘর্ষ হয়। এতে ওই দিন একজন মারা যান। পরে একজনের লাশ উদ্ধার করা হয় ধানখেত থেকে। সাঁওতালদের অভিযোগ, দুজন ওই হামলায় আহত হয়ে মারা গেছেন। এ সময় আহত হন পুলিশসহ ২০ জন। সংঘর্ষের সময় গুলি লাগে দ্বিজেনের শরীরে। তাঁর বোন মার্থা বলছিলেন, রক্তাক্ত দ্বিজেনকে তাঁরা কয়েকজন মিলে প্রথমে দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট, পরে পার্বতীপুর নেন। শেষে রাত ১০টার দিকে নেওয়া হয় রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। মার্থা বলেন, সেখানে পুলিশ চলে আসে। ভাইকে গ্রেপ্তার দেখায়।
সংঘর্ষের পর গোবিন্দগঞ্জ থানার পুলিশ এ ঘটনায় দুটি মামলা করে। গ্রেপ্তার করা হয় চার সাঁওতালকে। এই গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের একজন দ্বিজেন।

No comments:

Post a Comment

Pages

 

Sample text

Sample Text

 
Blogger Templates